কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি-মেঘনা) আসনের সংসদ সদস্য ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব.) মোঃ সুবিদ আলী ভূঁইয়ার ৭৪ তম জন্মদিন ২৮ জুলাই। ১৯৪৫ সালের ২৮ জুলাই কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার জুরানপুর গ্রামের প্রসিদ্ধ ভূঁইয়া বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম আঃ হালিম ভূঁইয়া, মাতা মরহুমা বেগম করিমুন্নেছা। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। সুবিদ আলী ভূঁইয়ার পিতাসহ মরহুম জইনউদ্দিন ভূঁইয়া দাউদকান্দি উপজেলার (বর্তমান তিতাস উপজেলা) অন্তর্গত বলরামপুর ইউনিয়নের অধীনে গাজীপুর প্রসিদ্ধ ভূঁইয়া বাড়ি থেকে জুরানপুরে বসতি স্থাপন করেন। উল্লেখ্য, সোনারগাঁওয়ের শাসক বার ভূঁইয়াদের একজন অধঃস্তন পুরুষ গাজীপুর ভূঁইয়া বাড়ির প্রথম পুরুষ ছিলেন।
সুবিদ আলী ভূঁইয়া শিক্ষা জীবন শুরু তার গ্রাম থেকে ১ কিলোমিটার দূরে ঝাউতলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরে জামালকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান তিনি ৪ বছর অধ্যয়নের পর ১৯৬০ সালে দাউদকান্দি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৬২ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। ১৯৬৫ সালে স্যার সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে বিএ (অনার্স) পাশ করেন। একই বছর তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। চাকরিকালীন ১৯৭৯ সালে তিনি মালয়েশিয়া থেকে কৃতিত্বের সাথে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পিএসসি ডিগ্রী অর্জন করেন।
ছাত্রজীবন থেকেই সেনাবাহিনীতে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে যোগদানের স্বপ্ন ছিল তাঁর। ১৯৬৫ সালে আইএসএসবিতে নির্বাচিত হয়ে পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমিক ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করলে তাঁর সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটে। এরপর ভূঁইয়া বেলুচ রেজিমেন্ট কমিশন লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে কোয়েটার ৩৬নং বেলুচ রেজিমেন্টে সেকেন্ড লেফটেন্যান্স হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে ক্যাপ্টেন হিসেবে চট্টগ্রাম সপ্তম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। একই বছর তিনি চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে বদলি হন।
সুবিদ আলী ভূঁইয়া বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কাতারের একজন বীরযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তখনকার সেই তরুণ ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া দেশ ও জাতির মুক্তির লক্ষ্যে পুরো নয় মাস জীবনবাজি রেখে বীরত্বের সাথে লড়াই করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম লড়াই ২৬ মার্চ ঐতিহাসিক কুমিড়ার লড়াই তাঁর নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিল। যা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে পাক হানাদার বাহিনীর কাছে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। এই যুদ্ধে পাকিস্তানী কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্ণেল শাহপুর খান বখতিয়ার ও একজন লেফটেনেন্টসহ বিভিন্ন পদে ১৫২ জন পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। কুমিড়ার এই লড়াইটিই ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম ও মুখোমুখি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। কুমিড়ার যুদ্ধের এই সাফল্য ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের টানিং পয়েন্ট। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে ২৯ মার্চ ১৯৭১ সালে তাঁর নামে চট্টগ্রামের কালুরঘাটের মদনাঘাটস্থ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে একটা ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। ঘোষণাটি ছিল ‘যার যার অস্ত্র নিয়ে লালদীঘি ময়দানে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার কাছে রিপোর্ট করুন’। সেই দিনের সেই ঘোষণা আর কুমিড়ার লড়াই আজ ইতিহাসের অংশ। জেনারেল ভূঁইয়া ৩নং সেক্টরের তেলিয়াপাড়া, ধর্মগড়, মুকুন্দপুর, আশুগঞ্জের যুদ্ধেও অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন। উল্লেখ্য, নয় মাসের যুদ্ধে বহুবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মরতে মরতেই তিনি বেঁচে যান। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রামে এবং পরে সিলেট অঞ্চলে মেজর সফিউল্লাহ নেতৃত্বে দেশ শত্রু মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধে লড়ে যান তিনি।
স্বাধীনতার পর আর দশজনের মতো সুবিদ আলী ভূঁইয়াও কঠিন শ্রম ও মেধা দিয়ে সেনাবাহিনীকে গড়ে তুলেন। দীর্ঘ ৩২ বছর সেনাবাহিনীতে সততা, আন্তরিকতা ও দক্ষতার সাথে চাকরিকালীন সময়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য কয়েকটি হল, ১৯৮৮ সালের প্রলয়ঙ্করি বন্যায় তিনি টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে বিগ্রেড কমান্ডার হিসেবে বন্যা প্লাবিত প্রায় ৩০ হাজার বন্যার্ত লোককে সেনানিবাসে আশ্রয়-সেবা দিয়ে মানবিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর এই ত্রাণ তৎপরতা বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকাতে প্রচারিত হয়। বিশেষ করে ঘাটাইলের ত্রাণ তৎপরতা দেশী পত্রিকাগুলোর পাশাপাশি নিউইয়র্ক টাইমস্, লন্ডন ডেইলি, অস্ট্রেলিয়ার দি এজ, ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন প্রতিবেদন ছাপায়। এছাড়া বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে এই সংবাদ নিয়মিত প্রচার করা হয়। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক মহাদুর্যোগে সরকারের চীফ কো-অর্ডিনেটর হিসেবে সুবিদ আলী ভূঁইয়া সেই মহাদুর্যোগের পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেনÑ যা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। শতাব্দির প্রচন্ডতম জলোচ্ছ্বাসে গোটা জাতি যখন দিশেহারা, দু’লাখ লোকের মৃত্যুতে হতবিহ্বল তখন প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও সমন্বয় সেলের মুখ্য সমন্বয়কারী হিসেবে ত্রাণ কর্মকান্ড অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পালন করেন। এসময় জেনারেল স্ট্যাক পোলের নেতৃত্বে বিপুল ত্রাণ সামগ্রী, সরঞ্জাম, হেলিকপ্টার পৌছায়। সঙ্গে মার্কিন টাস্কফোর্সের এক সুবিশাল বাহিনী। তাদের অপারেশন সী-এঞ্জেলস্’র পাশাপাশি দেশী-বিদেশী সংস্থা ও মিশনের সাথে এদেশের বেসামরিক ত্রাণ তৎপরতায় সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটিয়ে জনাব ভূঁইয়া আরও একবার দেশ সেবার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ১৯৯৮-এর প্রলয়ঙ্করী বন্যায় তথা প্রাকৃতিক দুর্যোগে দাউদকান্দির প্রত্যন্ত-দুগর্তদের পাশে সাধ্যমতো সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন তিনি। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে দুর্যোগ মোকাবেলায় সাহস যুগিয়েছেন। ২০০৪-এর বন্যায়ও একই কর্মসূচী হাতে নেন। চাকরি জীবনে সুবিদ আলী ভূঁইয়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দীন আহমদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার (১৯৯১-৯৬) সরকারের সময় প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে কয়েকদিন শেখ হাসিনারও পিএসও ছিলেন তিনি। সব মিলিয়ে তার মোট ৫ বছর ৮ মাসই কেটেছে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের পিএসও হিসেবে।
সেনাবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে যে কজন বহুল আলোচিত ব্যক্তি মেধা, দক্ষতা ও সততার স্বাক্ষর রাখেন তাঁদের মধ্যে সুবিদ আলী ভূঁইয়াও একজন। সুবিদ আলী ভূঁইয়া সেনাবাহিনীতে তাঁর যোগ্যতা, সততা, দক্ষতা ও কঠোর কর্মনিষ্ঠার জন্য স্বীকৃতি স্বরূপ ধাপে ধাপে পদোন্নতি পান। তিনি যুদ্ধ ক্ষেত্রে মেজর, ১৯৭৩ সালে লেফটেনেন্ট, ১৯৭৮ সালে কর্ণেল, ১৯৮২ সালে ব্রিগেডিয়ার এবং ১৯৯২ সালে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। তাছাড়া চাকরি জীবনে তিনি বিভিন্ন পদকে ভূষিত হন। এর মধ্যে তামগায়ে জং, রণতারকা, সমরপদক, মুক্তিতারকা, জয়পদকসহ বেশ কয়েকটি পদক রয়েছে তার।
জেনারেল ভূঁইয়া ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্দলীয় প্রার্থী হিসাবে অংশ নেন। ২০০৩ সালের আওয়ামী লীগে যোগদানের পর থেকেই তার নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপকভাবে গণসংযোগ করেন। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি-মেঘনা) থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে তিনি বিদ্যুৎ ও জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীর বিরুদ্ধে ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা তৃতীয় বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে পুনরায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সুবিদ আলী ভূঁইয়ার সহধর্মিনী বেগম মাহমুদা আখতার ভূঁইয়া। মাহমুদা ভূঁইয়া দাউদকান্দির বিটেশ্বরের ঐতিহ্যবাহী ভূঁইয়া পরিবারের বিদ্যুৎসাহি, সাংস্কৃতিসেবী ও সমাজসেবক, বিশিষ্ট প্রকাশক, আহমাদ পাবলিশিং হাউসের স্বত্বাধিকারী স্বর্ণপ্রদকপ্রাপ্ত মরহুম মহিউদ্দিন আহমদের কন্যা। তিন ছেলের জনক সুবিদ আলী ভূঁইয়া। তারা সবাই মির্জাপুরে ক্যাডেট কলেজে কৃতিত্বের সাথে লেখাপড়া শেষ করেন। দ্বিতীয় ছেলে শওকত আলী মেধা তালিকায় এসএসসিতে ৭ম এবং এইচএসসিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। বর্তমানে তিনি ইংল্যান্ডে কর্র্মরত। ছোট ছেলে জুলফিকার আলীও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত। বড় ছেলে মোহাম্মদ আলী সুমন সেনাবাহিনীতে মেজর পদে ইস্তফা দিয়ে রাজনীতিতে যুক্ত হন। বর্তমানে তিনি দাউদকান্দি উপজেলা চেয়ারম্যান এবং জেলা আওয়ামী লীগ নেতা।