সিলেটের ১০টি উপজেলা ও মহানগর এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এসব উপজেলার গ্রাম ও সিটি এলাকায় পানি ঢুকে পড়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। এদের মধ্যে প্রায় ১৩ লাখ মানুষ বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকটে ভুগছেন।
নগর ঘুরে দেখা গেছে, নগরের এক লাখের বেশি বাসা-বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছে। নগরের ছড়ারপার, কলাপাড়া, ডহর, শামিমাবাদ আবাসিক এলাকা, গোটাটিকর, সাদাটিক, শাপরান, সিলেট সার্কিট হাউজ-তালতলা ভিআইপি রোডের তালতলা, কালিঘাট, বেতবাজার, তেরতন, শাহজালাল উপশরসহ প্রায় ৬৫টি এলাকায় বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার রাস্তায় পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন প্রায় তিন লাখ নগরবাসী।
গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ ও সিলেট সদর, বিশ্বনাথ, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলাসহ পুরো জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় ১২ লাখ মানুষ।
জকিগঞ্জ উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। উপজেলার সাতটি স্থানে সুরমা নদীর ডাইক ভেঙে শনিবার (১৪ মে) থেকে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। কুশিয়ারার বিভিন্ন স্থানে ডাইকের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সুরমা নদীর ডাইক ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
নিকপুর কাজলশার ও বারহাল ইউনিয়নের অন্তত ৩৫টি গ্রামে পানি ঢুকেছে। বুধবার শাহগলী বাজারে দুই থেকে তিন ফুট পানি দেখা গেছে। বালাই ও মইলাট হাওরের অন্তত সাতশ একর পাকা বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে।
কয়েকদিনের বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে বন্যায় উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। নতুন করে প্লাবিত হয়েছে দরবস্ত, ফতেপুর ও চিকনাগুল ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম।
মঙ্গলবার (১৭ মে) দরবস্ত, ফতেপুর, চিকনাগুল ও জৈন্তাপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ দেখা গেছে। বন্যাকবলিত গ্রামের মানুষ গৃহপালিত পশু-পাখি নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন। জৈন্তাপুর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব অঞ্চলের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়কে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
বিশ্বনাথ উপজেলায় প্রতিদিনই নতুন নতুন গ্রাম পানির নিচে চলে যাচ্ছে। সুরমাসহ প্রধান নদী-নদীগুলোর পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে নদ-নদীর পানি বেড়ে বিভিন্ন উপজেলায় পানি ঢুকে পড়েছে।
বিশ্বনাথ উপজেলার লামাকাজী ইউনিয়নের মির্জারগাঁও, মাহতাবপুর, মাধবপুর, শাহপুর, সাহেবনগর, শাখারীকোনা, মাখরগাঁও, আকিলপুর, রসুলপুর, তিলকপুর, বাওনপুর, মির্জারগাও, হাজারীগাঁও, খাজাঞ্চীসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকায় বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। অনেক এলাকার রাস্তায় হাঁটুপানি।
কোম্পানীগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে বসতবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আউশ ধানের বীজতলা ও রাস্তাঘাট। অনেকেই আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে ও নিকটবর্তী আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন। বন্যাদুর্গতরা খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে আছেন। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে বন্যা আরও বাড়ার শঙ্কা করছেন উপজেলাবাসী।
সিলেট মহানগরের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে পরিবার নিয়ে অবস্থান করছেন জালাল আহমেদ। বুধবার দুপুরে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘গতকাল রাতে শুকনা খাবার খেয়ে রয়েছি। এরপর এখন পর্যন্ত কোনো খাবার পাইনি।’
গোয়াইনঘাট উপজেলার দুর্গেশ সরকার জানান, বন্যার পানিতে তার বাড়ির টিউবওয়েল নিমজ্জিত হয়েছে। পানিতে ঘরের আসবাবপত্রের ব্যাপক হয়েছে। তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে উঁচু জায়গায় অবস্থান করছেন।
গোলাপগঞ্জের বাঘা ও ফুলবাড়ি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত হয়েছে এ দুই ইউনিয়নের বিভিন্ন জনপদ। পানিবন্দি রয়েছেন লক্ষাধিক মানুষ।
গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাট উপজেলার সঙ্গে সিলেটের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই দুই উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি খুবই নাজুক।
মঙ্গলবার কানাইঘাট উপজেলায় বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছেন জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান। কানাইঘাট উপজেলা ও পৌরসভায় এরই মধ্যে ৩৯ মেট্রিক টন চাল ও ৫০০ বস্তা শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। গোয়াইনঘাট উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে ২২ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাইয়িদ চৌধুরী বলেন, আগামী কয়েকদিন এই বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বৃষ্টিও কমছে না। তাই পাহাড়ি ঢল নামছে এবং আমাদের দেশেও পানি বাড়ছে।