পরিবেশ উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখায় জাতীয় পরিবেশ পদক-২০২১-এর জন্য মতিন সৈকত-কে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।২৪ ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিবেশ পদক- ২০২১ প্রদান সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় অন্যদের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার, সচিব মো. মোস্তফা কামাল, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মাহবুব হোসেন, মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ) মো. মনিরুজ্জামান, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরীসহ কমিটির সদস্য হিসেবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ ক্যাটাগরিতে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার এম, এ মতিন (মতিন সৈকত) এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশন মনোনীত হয়েছে। পরিবেশবিষয়ক শিক্ষা ও প্রচার ক্যাটাগরিতে ব্যক্তিগত পর্যায়ে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন ঢাকা জেলার ইনাম আল হক এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বেসরকারি পরিবেশ, উন্নয়ন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডেজেনাস নলেজ (বারসিক)।
জাতীয় পরিবেশ পদকপ্রাপ্ত প্রত্যেক ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে ২২ ক্যারেট মানের দুই তোলা ওজনের স্বর্ণের বাজারমূল্যসহ আরো ৫০ হাজার টাকার চেক, ক্রেস্ট এবং সনদপত্র প্রদান করা হবে। এ পদক সাধারণত জুন মাসে অনুষ্ঠেয় বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদান করেন।
পরিবেশ, জলবায়ু, কৃষি-নদী, নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক জনসচেতনতা এবং গবেষণা মূলক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিবেশ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মতিন সৈকত কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার ইলিয়টগঞ্জ দক্ষিণ ইউনিয়নের আদমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সার্টিফিকেট অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ বাইশ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩। তাঁর মা শাহানারা বেগম। বাবা প্রখ্যাত সমাজকর্মী প্রয়াত মোঃ কেরামত আলী। তিনি মসজিদ, মাদ্রাসা, ঈদগাহ, কবরস্থান, ভূমিহীন স্বজনদের জন্য প্রায় ১০০ শতাংশ জমি দান করাসহ বহু উন্নয়নমূলক কার্যক্রম করে গেছেন। তার দানকৃত প্রতিষ্ঠান আদমপুর আদর্শ কমপ্লেক্সে। সাত সন্তানের মধ্যে মতিন সৈকত পঞ্চম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাংলা সাহিত্যে বি,এ অনার্স সহ এম এ পাশ করেন ১৯৯৩ সালে। ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি অধ্যাপনায় নিযুক্ত। মতিন সৈকত ১৯৮৭ সালে তার নিজ গ্রাম আদমপুর এবং পার্শ্ববর্তী পুটিয়া, বিটমান তিন গ্রামের কিশোর যুবকদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন পি,এ,বি ক্লাব। মূলত সে সময় থেকে তিনি কৃষি পরিবেশ সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে চলছেন। মতিন সৈকত ১৯৮৭ সালে দশম শ্রেণিতে পড়ার ময় সৃজনশীল কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ -এর লেখা অভিনন্দন পত্র পেয়ে অনুপ্রাণিত হন। তাঁর পিতা বলতেন ‘পাঁচে পদে মানুষ হও। ক্ষেতে গেলে লাঙল চালাতে হবে। মসজিদে গেলে ইমামতি করতে হবে। শালিসে গেলে সাবস্ত করতে হবে। সমাবেশে গেলে বক্তৃতা দিতে হবে। সব সময় মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে। মতিন সৈকত তার পিতার আদর্শ লালন করেন। সারাদেশে বোরোধান উৎপাদন করতে মৌসুমব্যাপী সেচের পানির জন্য কৃষককে সেচ প্রকল্পের মালিককে যখন বিঘাপ্রতি ১০০০থেকে ২০০০ টাকা খরচ দিতে হয়। সেখানে মতিন সৈকত ১৯৯৭ সাল থেকে আদমপুর এবং পুটিয়া ও সিঙ্গুলা তিন গ্রামের মধ্যবর্তী ১৫০ বিঘা বোরোধানের জমিতে ধান লাগানো থেকে পাকা ধান কাটা পর্যন্ত ২৬ বছর যাবত মাত্র দুইশ টাকা বিঘাপ্রতি মৌসুমব্যাপি সেচের পানি সরবরাহ করে ধান উৎপাদনে সহযোগিতা করে জাতীয় দৃষ্টান্ত স্হাপন করেন। মতিন সৈকত প্রত্যেক বছর বোরোধানের জমিতে ঝাটা-জিংলা পুতে দেন যাতে পাখি বসে পোকামাকড় খেয়ে ফসলকে নিরাপদ রাখে। এতে কোন ধরনের কীটনাশক বা বিষ ব্যাবহার করা লাগেনা। বিষ, মাটি, পানি, বাতাস, ফসল ও অর্থ নষ্টের পাশাপাশি জনস্বাস্থের ক্ষতি করে। তিনি ফসলের মৌসুমে ঢোল পিটিয়ে মাইকিং করে এলাকার কৃষকদের কীটনাশক বা বিষের ভয়াবহ ক্ষতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করেন। সেচের পানির উৎস কালাডুমুর নদ মতিন সৈকতের উদ্যোগে সরকারি অর্থায়নে ১১ কিলোমিটার পূনঃখনন হয়েছে। যার ফলে চারটি উপজেলার পঞ্চাশ হাজার বিঘা জমিতে ১২,৫০,০০০ মণ বোরোধান উৎপাদনে সহায়ক হবে। কালাডুমুর নদে’র বাকি অংশসহ এলাকার খাল-নদী পূনঃখনন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। একমাত্র ফসল বোরোধান উৎপাদনের পরে এখানকার প্লাবনভূমির জমিগুলো বর্ষায় অলস অনাবাদি পরিত্যক্ত থাকত। ঘাস, কচুরিপানা, আবর্জনা জমে জঞ্জাল তৈরি হত। পরিস্কার করতে বিঘাপ্রতি ৪/৫ হাজার টাকা লাগত। বেকারত্ব, সামাজিক অবক্ষয়রোধে কর্মসংস্থান সৃষ্টি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গণশেয়ারের ভিত্তিতে স্হানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে সমাজ ভিত্তিক আদমপুর, পুটিয়া, সিংগুলা তিন গ্রামের মধ্যবর্তী ২৫০ বিঘা জমিতে আপুসি এবং পুটিয়াতে ১০০বিঘা জমিতে বিসমিল্লাহ, আদমপুর, পুটিয়া, বিটমান তিন গ্রামের মাঝখানে ৩৫০বিঘা জমিতে আপুবি মৎস্য চাষ প্রকল্প সমবায় ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করেন। এসব প্রকল্পে প্রতি বছর পরিবেশ সম্মত মাছ চাষ করে জনগণ লাভবান হচ্ছেন। স্হানীয় জনগণের ব্যাবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি অর্থ ও পুষ্টির চাহিদা পুরণ হচ্ছে। বেড়িবাঁধ তৈরি করে নতুন নতুন রাস্তা বানানোর ফলে সেখানে গাছ লাগিয়ে পরিবেশের উন্নয়ন হচ্ছে। বোরোধান উৎপাদনে খরচ কমানোর সাথে বর্ষায় অনাবাদি জমিতে মাছ চাষ করার ফলে কৃষক লাভবান হচ্ছেন। বিঘাপ্রতি ১৪/১৫ হাজার টাকা করে প্রতিবছর মাছ চাষ থেকে ফসল উৎপাদন খরচ ছাড়া অতিরিক্ত পাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কৃষক। মতিন সৈকত দাউদকান্দি উপজেলা কেন্দ্রীয় আইপিএম-আইসিএম ক্লাবের সভাপতি। বিষমুক্ত ফসল নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে দাউদকান্দি মডেল উপজেলা এবং প্লাবন ভূমিতে মৎস্য চাষে দাউদকান্দি মডেল উপজেলা বাস্তবায়নের অন্যতম উদ্যোক্তা। জাতীয় পাট চাষি সমিতি কুমিল্লা জেলা সভাপতি। বাংলাদেশ কৃষি পরিবেশ আন্দোলন বাকৃপা’র সভাপতি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা’র সদস্যসহ বহু সামাজিক উন্নয়ন সংস্থার সাথে কৃষি পরিবেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করছেন।
সারাদেশে মাত্র ১০টি ইউনিয়নকে সরকারিভাবে আইপিএম মডেল ইউনিয়ন ঘোষণা করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। পরিবেশ বান্ধব কৌশল অবলম্বনে নিরাপদ সবজি উৎপাদনে মতিন সৈকতের ইলিয়টগঞ্জ দক্ষিণ ইউনিয়ন আইপিএম মডেল ইউনিয়নের মর্যাদা পেয়েছে।
পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ, জীব বৈচিত্র্য, বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণের পাশাপাশি এক হাজার পাঁচ’শ’র বেশি পাখি এবং বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী উদ্ধার ও অবমুক্ত করেন। সবুজায়ন আন্দোলনে নার্সারি প্রতিষ্ঠা করেন। মহাসড়কের পাশের এবং শহর নগরের ময়লা আবর্জনাকে থেকে সিটিজেন ফার্টিলাইজার বা নাগরিক সার প্রক্রিয়াকরণ সহ বহুমুখী পরিবেশ উন্নয়নে সামাজিক আন্দোলনে নিরন্তর নেতৃত্ব দিয়ে চলছেন। পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন ব্যাবহার ও সম্প্রসারণের জন্য ২০১০ এবং ২০১৭ সালে মতিন সৈকত-কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক দিয়ে সন্মানিত করেন। পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যাক্তিগত ক্যাটাগরিতে তিনি সরকারিভাবে ছয় বার চট্টগ্রাম বিভাগে শীর্ষ স্থান অর্জন করেন।
একধিকবার জাতীয় পরিবেশ পদকের জন্য প্যানেলভূক্ত হয়েছেন। বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা তার কাজের জন্য অভিনন্দন জানান।
‘অব দ্যা বেটেনটেক দি ক্রপ ক্রুসেডার, এরিয়েল প্রেট্রিয়ট, এম্যান টুবিফলোইড, এন লাইটেড মতিন সৈকত, মতিন সৈকত এরিয়েল ফ্রেন্ড অব ফারমার্স ইন কুমিল্লা শিরোনামে অভিহিত হয়েছেন। প্রখ্যাত মিডিয়া ব্যাক্তিত্ত রামেন্দু মজুমদার, শাইখ সিরাজ, মুন্নী সাহা, প্রভাষ আমিন, রেজাউল করিম সিদ্দিক, দেওয়ান সিরাজ, রোম্মান রশিদ-সাদিয়া ওহাব তাকে নিয়ে টেলিভিশনে প্রামাণ্য অনুষ্ঠান করেন।
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা বিবিসি টেলিভিশন তার কাজের তথ্যচিত্র প্রচার করে। দাউদকান্দি উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ সারোয়ার জামান বলেন ‘আদমপুর গ্রামের পরিবেশ যোদ্ধা অধ্যাপক মতিন সৈকত উপজেলার কৃষকদের খুব আপনজন।
সরকারের পাশাপাশি তৃণমূলে কৃষকের পাশে থেকে সব সময় সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন। তিনি ২৬ বছর ধরে নাম মাত্র মূল্যে মাত্র দুইশ টাকায় বিঘাপ্রতি সেচ ব্যবস্থা করে কৃষকদের সেবা দিয়ে আসছেন। তিনি কৃষকদের যেভাবে সংগঠিত করে তাদের সহযোগিতা করছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। ‘দাউদকান্দি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মেজর (অবঃ) মোহাম্মদ আলী সুমন উল্লেখ করেন। “মতিন সৈকত কৃষি ও পরিবেশ উন্নয়নে ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে দেশব্যাপী দৃষ্টান্ত স্হাপন করেছেন। বিষমুক্ত ফসল, নিরাপদ খাদ্য আন্দোলন, খাল-নদী পূনঃখনন, বন্য প্রাণীসহ পাখি উদ্ধার ও অবমুক্ত, জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণের পাশাপাশি বহুমুখী সামাজিক আন্দোলন করে যাচ্ছেন। মহাসড়কের দুই পাশের ময়লা আবর্জনা, শহর- নগরের বর্জ্যকে রুপান্তরিত করে সিটিজেন ফার্টিলাইজার বা নাগরিক সার রুপান্তর কারার জন্য সরকারের নিকট জোর দাবি জানিয়ে আসছেন। কালাডুমুর নদ পূনঃখনন মতিন সৈকতের আন্দোলনের ফসল। পরিবেশ উন্নয়নে নিবেদিত মতিন সৈকত। ‘পরিবেশ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপ-পরিচালক শওকত আরা কলি জানান ‘জেলায় পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মতিন সৈকতের নানা কর্মকান্ড সত্যই আমাদের মুগ্ধ করেছে। সরকারি কোন সহায়তা ছাড়াই সমাজে পরিবেশের জন্য যদি কেউ কাজ করে থাকে তাহলে মতিন সৈকত হতে পারেন মডেল।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এবং তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ সচিব রইস-উল- আলম মন্ডল দাউদকান্দি প্লাবনভূমিতে মৎস্য চাষ পরিদর্শনে এসে বলেন ‘ পরিবেশ কর্মী মতিন সৈকত কে নিয়ে আমরা অনেক অনুষ্ঠান করেছি। পরিবেশ সংরক্ষণে তার অবদান স্বরণীয়। পরিবেশ আন্দোলন তিনি একজন সফল সংগঠক’। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার ডক্টর কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন ‘মতিন সৈকত ত্রিশ বছর যাবত পরিবেশ নিয়ে কাজ করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে কাজটি খুবই চ্যালেনজিং। নিঃস্বার্থভাবে তিনি এ কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও পাখি উদ্ধার ও অবমুক্ত করণে তাঁর ভূমিকা প্রশংসনীয়। আমি এ ক্ষেত্রে তাঁর আরো সফলতা কামনা করি। ‘সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অবঃ) মোঃ সুবিদ আলী ভূইয়া বলেন
‘মতিন সৈকত কৃষি, পরিবেশ উন্নয়নে দুই দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করে জাতি গঠনে অবদান রাখছেন”।