প্রশাসন ও পুলিশ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি
এখন থেকে আরো ৭ দিন নিরাপদ দূরত্ব কিংবা হোম কোয়ানেন্টাইনে থাকলে চাঁদপুরসহ সারা দেশে করোনা আতঙ্ক অনেকটাই কমে আসবে বলে অভিমত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ হিসেবে তারা বলছে, যারা দেশের ভেতরে ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গেছেন তাদের সংক্রমনের দু’সপ্তাহ শেষ হয়ে গেছে। এখন ভাইরাসটির তার বংশ বিস্তারের জন্য ডিম ফুটানোর মাধ্যমে নতুন করে সংক্রমন ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে চলতি সপ্তাহে। এজন্য চলতি সপ্তাহে করোনা ভাইরাস সংক্রমন ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
এমন পরিস্থিতে সামাজিক দূরত্ব বজিয়ে না রাখলে বা বাইরে বেরোলে অনেকেই সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে। ফলে সবার ঘরে থাকাটা এ সপ্তাহে খুবই জরুরি। সেজন্য আগামি ৭ এপ্রিল পর্যন্ত সবাই সতর্ক হলে বড় ধরনের দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। এবং পরবর্তী সময়ে করোনাভাইরাসটি তার শক্তি হারাতে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা এমন পূর্বাভাস দিয়েছেন, ইতালির পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। দেখা গেছে, ইতালিতে করোনা সংক্রমনের দুই সপ্তাহকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি দেশটির লোকজন। যার ফলে প্রতিদিন দেশটিতে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে চাঁদপুরসহ সারা দেশের লোকজন আগামি ৭ এপ্রিল পর্যন্ত বাসা-বাড়ি থেকে বের না হলে আমরা বড় ধরনের দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবো বলে আশা করা হচ্ছে।
এদিকে এ সপ্তাহকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে সরকার আরো এক সপ্তাহের সরকারি ছুটি ঘোষণা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি ছুটি বহাল থাকলেও তা আগামি ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বর্ধিত হবে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে।
বিপরীত দিকে প্রশাসন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিপর্যায়ে দুঃস্থ, অসহায় ও কর্মহীন মানুষদের জন্য খাদ্য সহায়তাসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্য সামগ্রী প্রদান নিয়ে চাঁদপুরে উঠছে অভিযোগ। এখানে অনেক স্থানেই মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব বঝায় রাখার নিয়ম। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে করোনা আতঙ্ক পর্যায়ক্রমে বাড়তে পারে চাঁদপুরে।
এদিকে চাঁদপুরের গ্রামঞ্চলের হাট-বাজারে অবাধে মানুষের চলাচল করোনা আতঙ্ককে উদ্বেগ পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। সারা দেশের মানুষ এমন পরিস্থিতির পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় তারা হোম কোয়ারেন্টাইনসহ সামাজিক রূরত্ব বজায় রেখে চলছে না। প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মৃদু শাস্তির ব্যবস্থা করলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক নেতিবাচক পরিস্থিতির উদ্ভব করলে প্রশাসন এখন সচেতনা বৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করছেন। যার কারণে পরিস্থিতি উন্নতি না হয়ে অবনতি হচ্ছে।
গতকাল মঙ্গলবার চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জামান তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এভাবে, ‘এক স্থানে জটলা দেখে কাছে এগিয়ে গিয়ে অত্যন্ত মার্জিতভাবে নরম স্বরে বললাম আপনারা ভীড় করবেন না। যার যার বাসায় চলে যান। পাত্তাই দিল না। দ্বিতীয়বার একটু কড়া করে বললাম। জটলা থেকে এক মরুব্বি বলে উঠলেন ‘ধমক দিবেন না। এক ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি কিন্তু খায়া ফালাইছি কালকে’। আমি ভয়ে পিছিয়ে আসলাম। যাক বাবা আগে চাকরি বাঁচাই, পরে অন্য কিছু।’
চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের বাস্তব অভিজ্ঞতাই জানান দেয় আমাদের সামাজিক অবস্থান কোন পর্যায়ে রয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের এমন দায়িত্বহীনতার কারণে গত কয়েকদিনে সারাদেশে কেবল সর্দি-জ্বরে প্রায় ২৪ জনের প্রাণ গেছে। পাশাপাশি গতকাল শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে সর্দি, জ্বর এবং শ্বাসকষ্টে আরো এক ব্যক্তি মারা গেছেন। পরে সর্দি আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির বাড়ির আশেপাশের কয়েকটি বাড়ি ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে স্থানীয় প্রশাসন।
বর্তমানে সারা বিশ্বে একযোগে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পরার কারণ হিসেবে গবেষকরা বলছেন, ভাইরাস আসলে হলো এমন এক পদার্থ। এরা জড় হিসেবেই থাকে কিন্তু একবার কোনও জীবের ভিতরে প্রবেশ করলে সেই জীবের জীবন সঞ্চালন প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করে জীবিত জীবাণুতে রূপ নেয় এবং তার সাহায্যে দ্রুত নিজদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে থাকে এবং সেই জীবের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটিয়ে ফেলতে পারে তারা। বৈজ্ঞানিক বিবেচনায় প্রত্যেকটি ভাইরাস অনুগতভাবে এক প্রকার প্রাণিকে সংক্রমিত করে তারা নিজেদের জিনের পরিবর্তন ঘটিয়ে পশু থেকে মানুষকে লক্ষ্য বানিয়ে ফেলে। পরে ঘাতক রূপে মানুষের শরীরে ভয়ঙ্কর সংক্রমণ ঘটায়।
গবেষকরা দাবি করছেন, এইচআইভি, সার্স, মার্স, ইবোলা, মারবুর্গ, ওয়েস্ট নাইল, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, নিপা ও জিকা-র মতো ভাইরাসের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন কার্যকর প্রতিষেধক তৈরি করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে প্রায় পাঁচ হাজার করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে বিজ্ঞানীরা। যার বেশির ভাগই মানুষের জন্য ক্ষতিকারক নয়।
তারা বলছেন, সার্স করোনাভাইরাসের পরিবর্তিত রূপ বা উত্তরসূরীই নোভেল করোনাভাইরাস যা সার্স-কোভ-২ (ঝঅজঝ-ঈড়ঠ-২) নামে পরিচিত এবং এর ঘটানো রোগের নাম কোভিড-১৯ (ঈঙঠওউ-১৯) । ভয়ঙ্কর ভাইরাসদের মধ্যে এটি সাত নম্বর। এ রকম ভাইরাসের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে বিশ্বে। যা আস্তে আস্তে আমাদের জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে।
গবেষকদের দাবি, নোভেল করোনাভাইরাসটির মতো ভয়ঙ্কর সংক্রমণ এবং মারণ ক্ষমতা এর আগে কোনও জীবাণুতে দেখা যায়নি। ভাইরাসটির জিন গঠন থেকে দেখা যায়, ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটিয়ে তারা মানুষের মত্যুকে ডেকে আনে। এ ভাইরাসটির এক ভয়ঙ্কর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আক্রান্ত ব্যক্তিকে অসুস্থ না করেও ১৪ দিন অবধি নিজদের বিস্তার করে থাকে। আর এসব ব্যক্তিদের লক্ষণবিহীন বাহক হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না।
পরবর্তী সময়ে আক্রান্ত এসব ব্যক্তিরাই ভাইসরাসটি ছড়ানোয় (ঈড়সসঁহরঃু ংঢ়ৎবধফরহম) মূল ভূমিকা পালন করে। এই ধরনের সংক্রমিত ব্যক্তিরাই এই রোগকে ঝঃধমব-২ (নির্দিষ্ট এলাকায় সীমিত) থেকে ঝঃধমব-৩ (গোষ্ঠীর মধ্যে ছড়ানো) পর্যায়ে নিয়ে যেতে বেশি সাহায্য করে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা বলতে পারছি না এমন কতজন লক্ষণবিহীন ভাইরাসের বাহক সারা দেশে অজান্তেই সংক্রমণ ঘটাচ্ছে।
কারণ হিসেবে দেখা যায়, দেশে সাধারণ মানুষের ভাইরাসটির পরীক্ষা করে নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না- কে আক্রান্ত, আর কে সুস্থ। তাই দেশে এই সঙ্কটের প্রকৃত চিত্রটা এখনো নিশ্চিত করতে পারছে না কেউ। কিন্তু যে বিষয়টি আমাদের বার্তা দিয়ে যাচ্ছে তা হলো এত সতর্কতার পরেও উন্নত বিশ্বে করোনাভাইরাসটি খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে।
সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (ঈউঈ) জানিয়েছে, ভাইরাসটি হাওয়ায় (অ্যারোসল) তিন ঘণ্টার বেশি এবং প্লাাস্টিক, স্টিল বা অন্যকিছুর ওপর ২-৩ দিন বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু অতিসম্প্রতি নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন (ঘঊঔগ) জানাচ্ছে, করোনাভাইরাসটি ভারি হওয়ায়, ড্রপলেট মাটিতে পড়ে যায়। তাই বাতাসে ভেসে বেড়ানোর ক্ষমতা কম। ফলে বায়ুবাহিত (অরৎনড়ৎহব) হওয়ার সুযোগ নেই। তবে হাঁচি-কাশি মাধ্যেমে ১ মিটার বা ৩ ফুটের ভেতর আক্রান্ত করতে পারে।
এর চেয়ে বড় বিষয় হলো, যদি ভাইরাসটি জড় বস্তুর (ঋড়সরঃব) ওপরে বেঁচে থাকতে পারে ৭২ ঘণ্টা। আর সেটির সংস্পর্শে যে আসবে, সেই আক্রান্ত হবে। তাই উন্মুক্ত কোনকিছুই খালি হাতে স্পর্শ করা যাবে না বা করলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধুয়ে ফেলার জন্য অভিমত দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
বর্তমানে যেহেতু করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি তাই প্রতিরোধই একমাত্র কৌশল। যেহেতু মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় সে কারণে শরীরে ভাইরাস বহন না করে এবং অন্যকে সংক্রমিত করে তা মোকাবেলা করা দরকার। সেজন্য সবার সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার বিকল্প নেই। ফলে যারা উপসর্গ ছাড়াই ভাইরাসটি বহন করছে, তারা ‘কমিউনিটি’র মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা অনেকটাই কমে যাবে।